একটি ভালোবাসার গল্প "সব ফুল ভালোবাসার জন্য নয়"

-কিরে এমন ভাবে কি দেখছিস?
-তোকে শরৎচন্দ্রের নায়িকা মাধবীর মত লাগছে!কি যেন ছিল উপমা টা! “......অনেক কাল বৃষ্টি হইবার
পরে সূর্য উঠিলে হটাৎ যেমন লোকে সেদিকে চাহিতে চায় ,ক্ষণকালের কালের জন্য যেমন মনে থাকেনা সূর্যের পানে চাহিতে নাই! চাহিলে চক্ষু পীড়িত হয়.........” তেমনি আমার চক্ষুও পীড়িত হচ্ছে! আঁচলে মুখ ঢাক!
সিমা রিনঝিন করে হাসল। সে হাসি মাধবী লতার চেয়েও শুভ্র। অনেক বেশি পবিত্র।
আজ সিমার জন্মদিন। তাই এত সেজেছে সে। নীল রঙের শাড়িটা যেন আকাশের সবটুকু নীল ধারন করেছে বুকে। হয়ত সে পরেছে বলেই!
- তাড়াতাড়ি আয়! কেক কাটবো!

সিমার ডাকে ভাবনায় টান পড়লো।
একটা নীল পরি কেক কাটছে।তার পাশে ঘিরে আছে অনেক গুলা অনাথ আশ্রমের বাচ্চা। পরী টা সবাইকে কেক খাওয়াচ্ছে। বাচ্চাগুলার আনন্দ দেখে আমার মত কাঠখোট্টা মানুষেরও চোখ ছলছল করে উঠল। নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য অনেক সৌভাগ্যবান মনে হল।

আমি অবাক হয়ে ভাবি এত শক্তি কোথায় পায় মেয়েটা! প্রচণ্ড শীতে আমরা যখন কম্বল মুড়ি দিয়ে প্রেমিকার সাথে প্রেমালাপে উত্তপ্ত হওয়ায় ব্যাস্ত তখন সে ছুটে যায় কমলাপুরের বস্তি গুলোতে।ঘুমন্ত মানুষ গুলকে ডেকে হাতে তুলে দিয়েছিল মানুষের কাছ থেকে চেয়ে আনা একটা করে গরম কাপড়। এই ঘুনে ধরা সমাজের হিংস্র মানুষ গুলোকে কি একটুও ভয় পায়না মেয়েটা!

আসমার ফোন বাজছে। ধরতে ইচ্ছে করছে না।ধরলেই ঝারি খাবো। আয়তুল কুরছি পরে বুকে ফু দিয়ে ফোন ধরলাম!
- কই ছিলা সারাদিন? একটা বার ফোন দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলা না!
- জান প্লিজ, আজ সিমার বার্থডে!
- ও!!! এই কথা! এজন্যই সারাদিনে একটা বার আমার কথা মনে পরে নি! কাল তো আমার সাথে সিমা আপুর কথা হল কই তখনতো আমাকে আপু ইনভাইট করল না! নাকি গেস্ট হিসেবে তুমি একাই......।
লাইন টা কেটে দিলাম। এই অবুঝ মেয়েটা কে এখন যাই বলি তার মাথায় ঢুকবে না। মাথা ঠাণ্ডা হলে একটু পর নিজেই ফোন দিয়ে সরি বলবে। মেয়েটা একটু বেশিই ভালবাসে আমাকে!

বাসায় ফিরে অনেক বার ফোন দিলাম আসমাকে... কিন্তু ফোন ধরার নাম নেই। ফোন টা রাখতেই সিমা কল করল।
-স্যার , কালকে যে Exam নিবে, সে কথা কি মনে আছে? নাকি সারাদিন প্রেম করলেই পাশ করা যাবে?
সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম! কিন্তু লজ্জায় বলতে পারলাম না! ফোন রেখে পড়াশুনায় মন দিলাম! জীবনে প্রেমের চেয়ে অনেক জটিল কিছু সাবজেক্ট আছে তা বই খুলেই বুঝলাম।

সবকিছু নির্দিষ্ট দুরত্বে রেখে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। নাহ ৩ মাসের পড়া কি আর এক রাতে শেষ হয়? পরদিন যথারীতি পরীক্ষার আগ মুহূর্তে সিমার পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। জনৈক মহামানব বলেছেন “everything is fair in exam hall!” কিন্তু বিধি বাম। স্যার ৪ সেট প্রশ্ন করায় একটু বেকায়দায় পরে গেলাম। Exam শেষে মুখ ভার করে বসে আছি।
-সরি রে দোস্ত। স্যার আজ এত অল্প সময় দিছে যে তোর সব কোশ্চেন গুলার আনসার বলে দেয়ার সময় পেলাম না।

মহামানবির কথায় অবাক হলাম! সে লাস্ট মিনিটেও নিজের লেখা বাদ দিয়ে আমাকে বলে দিচ্ছিল! আর এখন বলে সরি! বুঝিলাম ইহারা অন্য জাতের মানুষ!
সামনেই ফাইনাল টার্ম পরীক্ষা। ইমপ্রুভ এর ভয়ে হলেও পড়ায় মন দিলাম। বিপদে পরলাম Electrical Machines আর Numerical Methods & Analysis নিয়ে। সিমা Electrical Machines এ ভাল। বুঝতে ক্লাস শেষেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরে থাকতাম ক্যাম্পাসে। গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে প্রায়ই সিমার অনেক দেরী হত।

পরিক্ষা চলাকালীন দিন গুলোতে আসমাকে একদম সময় দিতে পারছিলাম না। অভিমানীর সাথে দূরত্ব টা বেড়েই চলেছে। এর মাঝে একদিন ফোন দিয়ে ওয়েটিং পেলাম। বুকের ভেতর টা কেমন যেন করল। অনেকক্ষণ পর লাইন পেলাম। যে প্রশ্ন কখনও করিনি তাই করে বসলাম।
- কার সাথে কথা বললা এতক্ষণ!
- তুমি আমাকে সন্দেহ কর! করবাই বা না কেন! মানুষ যখন নিজে অন্যায় করে তখন দুনিয়ার সবাই কে অপরাধি মনে হয়।

বলেই ফোন টা কেটে দিল। বুঝলাম শুধু দূরত্ব বাড়েনি। বিশ্বাসের সুতোয়ও টান পরেছে। কিন্তু আমার তখন অতশত ভাবার সময় ছিল না। আরও একটা পরীক্ষা বাকি।

শেষ পরীক্ষার দিন লক্ষ্য করলাম সিমার মন খারাপ। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-কিরে মাদার তেরেসা মন খারাপ ক্যান?
- পরীক্ষা ভাল হয়নি তেমন। তা ছাড়া তোদের ছেড়ে এবার আমাকে যেতেই হচ্ছে..
- তোর আমেরিকা যাওয়া তাহলে হচ্ছেই না ?!
খুব বোকার মত প্রশ্ন করে আরও বোকা হয়ে গেলাম যখন দেখলাম মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে!
কি বলা উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না।
আসমার কথায় নীরবতা ভাঙল। কখন সে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। এরপর আসমা যা বলল তা সহ্য করার ক্ষমতা সিমা কেন পৃথিবীর কোন মেয়েরই নেই।
আমি সেদিন বন্ধুত্ব কে ভালবাসার উপরে স্থান দিতে পারিনি। তাই আর কোনদিন সিমার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাইনি।
তার কিছুদিন সিমা আমেরিকা চলে যায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। শুধু আমাকে কিছু বলেনি। এত কিছুর পর নির্লজ্জের মত আমি সেটা আশা করছিই বা কি করে!
আজ আমার প্রিয়া নিশ্চয়ই সাদা শাড়ি পরেছে। আজ তার বেলিফুল চাই। কিন্তু অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে সব গুলো ফুলের দোকান ঘুরেও কোথাও বেলিফুল পেলাম না। মুঠোফোনে অচেনা নাম্বার থেকে বার্তা এসেছে। পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। বাসায় গিয়ে পড়া যাবে।
বেলি ফুল দেখতে না পেয়ে আসমার একটু মন খারাপ হল বুঝতে পারলাম। কিন্তু যখন আলতো করে জড়িয়ে ধরে লক্ষ্মী বউ বলে ডাকলাম তখন সব অভিমান দূর হয়ে গেল। বলল ‘ চল ছাদে যাই।
একটা মাদুর পেতে তাতে রিক্তা বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমন স্বর্গীয় অনুভূতির মাঝে কেন মেসেজ টার কথা মনে পরল বুঝলাম না। পকেট থেকে ফোন তা বের করে পড়লাম। আসমাও পড়ল। খুব সাদামাটা উইশ।
“ বিবাহ বার্ষিকী শুভ হোক”
-সিমা

তবুও এইদিনটার সর্বশ্রেষ্ঠ উইশ মনে হল। আসমার চোখমুখে অনুশোচনার ছায়া অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম। খানিকটা ইতস্তত করে প্রশ্ন করল “ আচ্ছা তুমি সত্যিই কি কখনও সিমা কে ভালবাসনি?!"
পাগলী টা কে বুকের আর একটু কাছে এনে বললাম – "সিমা আমার ভেতরের এমন একটা সত্তা যাকে মন প্রান সঁপে শ্রদ্ধা করা যায় কিন্তু হৃদয় উজার করে ভালবাসা যায় না।" শুধু দুঃখ একটাই ও যে জিনিস সবচেয়ে অপছন্দ করত সেই ভুল বুঝেই আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেল। কখনও বলা হলনা- " তোর জন্য রাখা পূজার ফুল মন্দিরেই আছে। সেটা শুধু ভালবাসার জন্য নয়, কারণ- সব ফুল ভালোবাসার জন্য নয় !" 


1 কমেন্ট:

Unknown said...

অনেক দিন আগে লেখা।

Post a Comment